দিনে দিনে বেড়ে চলা যে অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে ভারত ক্রমশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে, ভারতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের শুরুতে গতকাল বৃহস্পতিবার সেটাই বড় হয়ে দেখা দিল। সেই সঙ্গে আলোচনায় উঠে এল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রও। দুই বিষয়েই সরকারকে কোণঠাসা করলেন কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। আর নাম না নেওয়া হলেও এই বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় নায়ক আমির খান।
ভারতীয় সংবিধান গ্রহণের ৬৫তম এবং সংবিধানের অন্যতম রূপকার বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে অধিবেশনের প্রথম দুই দিন বিশেষ এক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এই বিশেষ আলোচনাপর্বেই বড় হয়ে উঠে আসে অসহিষ্ণুতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। আর সেখানেই শাসক বিজেপিকে সরাসরি কটাক্ষ করে সোনিয়া বলেন, ‘সংবিধান রচনায় যাঁদের পূর্বসূরিদের কোনো ভূমিকাই ছিল না, সংবিধানের ওপর যাঁদের আস্থা নেই, তাঁরাই আজ সংবিধানরক্ষকের দাবি জানাচ্ছেন!’ আক্রমণাত্মক সোনিয়া বলেন, ‘কংগ্রেসই সংবিধানের জন্য লড়াই করেছে। অথচ আজ আমরা দেখছি, সংবিধানের মূল আদর্শগুলো ধ্বংস হওয়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েক মাস ধরে দেশে যা চলছে, তা সংবিধানের মূল ধ্যানধারণা ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।’
সংবিধান রচনা, তাতে আম্বেদকরের ভূমিকা এবং সংবিধানের বেঁধে দেওয়া মূল সুর অনুযায়ী ভারতের এগিয়ে চলা নিয়ে আলোচনা শুরু করে বিরোধী আক্রমণের মুখে পড়েন লোকসভার উপনেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। বলিউড সুপারস্টার আমির খানের নাম না করে প্রথমে তিনি কটাক্ষ করেন এই বলে যে ‘জীবনকালে আম্বেদকরকে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে, পদে পদে বাধা পেতে হয়েছে, কিন্তু তিনি কোনো দিন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবেননি।’
আমির খান গত সোমবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার ঘটনাগুলোয় তিনি আতঙ্কগ্রস্ত। তিনি বলেন, ‘নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিরণ (স্ত্রী) এতটাই উদ্বিগ্ন যে আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের কি ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত?’
আমির খানের এ মন্তব্যে ভারতে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্ক শুরু হয় বলিউডের ভেতরেও। আমিরের পাশে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত কেউ কেউ দিলেও, আক্রমণই সহ্য করতে হয় বেশি। ওই মন্তব্যের ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই আমির খান গত বুধবার বলেন, ‘আমার মন্তব্যের উল্টো মানে করা হয়েছে। আমার বা আমার স্ত্রী কিরণের দেশছাড়ার কোনো ইচ্ছা নেই।’
আমির খানের সাম্প্রতিক মন্তব্য ভারতে চলমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার একটি বহিঃপ্রকাশ। ভারতে স্বাধীন মত প্রকাশকারী একজন শিক্ষাবিদকে সম্প্রতি হত্যা করা হয়। এ ছাড়া গরুর মাংস নিয়ে গুজবের জেরে সহিংস হামলায় আরও দুজন নিহত হন। এসব ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতজুড়ে সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকারসহ অন্তত ৭৫ বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেন।
গতকাল সংসদে রাজনাথ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক শব্দ দুটি সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রথমে ছিল না। কারণ, আম্বেদকর মনে করেছিলেন, দুই বিষয়ই ভারতের মূল প্রকৃতির মধ্যে নিহিত। রাজনাথ বলেন, এ দেশে যে শব্দটির অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি, তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ। এই শব্দটির বদলে ‘পন্থ (পথ) নিরপেক্ষ’ ব্যবহার হওয়া উচিত।
রাজনাথের পরেই বলতে ওঠেন সোনিয়া। সংবিধান রচনায় কংগ্রেসের ভূমিকার উল্লেখ করে তিনি সরাসরি চলে আসেন সরকারের বিরোধিতায়। এবং তাতেও তাঁর হাতিয়ার হন আম্বেদকর। সোনিয়া বলেন, ‘আম্বেদকর বলেছিলেন, সংবিধান যতই ভালো হোক, যাঁরা তা রূপায়ণ করবেন, তাঁরা ভালো মানুষ না হলে সংবিধানও বাজে হয়ে যায়। আবার রূপায়ণকারীরা ভালো মানুষ হলে খারাপ সংবিধানও ভালো হয়ে যায়।’ এই টিপ্পনী কেটেই সোনিয়া বিরোধীদের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলেন, ‘এটা আপনাদের ও আমাদের উদ্দেশে।’
আম্বেদকর ও সংবিধান প্রথম দুদিনের বিশেষ অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় হলেও ঘুরেফিরে লোকসভায় প্রাধান্য পায় অসহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংরক্ষণ।
আজ শুক্রবার এই বিতর্কে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অসহিষ্ণুতা নিয়ে এযাবৎ মৌন প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম প্রকাশ্যে এবং সংসদে তাঁর ও সরকারের মনোভাব জানাবেন। তা যাতে নির্বিঘ্নে হয় এবং সংসদ যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে সে জন্য আবেদন জানিয়েছেন সংসদীয় মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু। তিনি বলেছেন, সরকারের লুকোনোর কিছুই নেই। সরকার সবকিছু নিয়ে আলোচনায় রাজি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন এই কথা।’